‘কতটা শিখলে জীবনযু’দ্ধে জিতবে তরুণ প্রজন্ম’

‘প্রশ্নটা কঠিন। কারণ ভবিষ্যতের জীবনযু’দ্ধ কেমন হবে, এটাই তো আমরা ঠিকঠাক জানি না এখনো। তবে প্রযুক্তি ও মানবজীবনে যে পরিবর্তন আমরা প্রত্যক্ষ করছি এবং যে কটা আশু পরিবর্তন সম্পর্কে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের পূর্ণাঙ্গ কোনো ছবি না হলেও একটা স্কেচ তো আঁকাই যায়।

 

সেটা যত তাড়াতাড়ি এবং যত ভালোভাবে আঁকা যাবে, জীবনযু’দ্ধে জেতার জন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মের হাতে তত দ্রুত এবং তত কার্যকর হাতিয়ার তুলে দেওয়া সম্ভব হবে। এ লেখায় পূর্ণাঙ্গ কোনো স্কেচও আঁকা যাবে না, তবে মানবজীবনের পরিবর্তনের ধারা নিয়ে দু-একটা কথা বলা যায়।

প্রথমেই দেখে নিই জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আমরা যারা বড়, তাদের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের ফারাকটা কোথায়। একসময় আমাদের জীবন মোটামুটি দুইভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম ভাগে আমাদের কাজ ছিল লেখাপড়া করা এবং কীভাবে এ জীবনটা যাপন করতে হবে তা শেখা; আর দ্বিতীয় ভাগে তার ওপর ভিত্তি করে কোনো একটি পেশায় ঢুকে গিয়ে জীবনটা পার করে দেওয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন ২০৪০ সালে গিয়ে বিষয়টা একেবারেই আর তেমন থাকবে না। একবার কিছু শিখে নিয়ে সেটা দিয়ে আপনি আপনার পুরো জীবনটা চালিয়ে নেবেন, তা হবে না। সবকিছু এত দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকবে যে আপনার জীবনের প্রথমভাগে অর্জিত যোগ্যতার পুঁজিটুকু সম্বল করে আরেক ভাগে চলতে গেলে আপনি বারবার হোঁচ’ট খাবেন।

আপনার বেছে নেওয়া পেশাও একসময় অচ”ল হয়ে যাবে। আপনাকে নিরন্তর নতুন নতুন জিনিস শিখতে হবে এবং নতুন নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে বারংবার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। আগে আপনার শেখার সময় এবং তা বাস্তবায়নের সময় ছিল আলাদা। এখন দুটি একসঙ্গে ঘটবে। অর্থাৎ আমাদের তরুণ প্রজন্ম যখন কিছু একটা শিখবে, তখনই তারা তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে

অথবা প্রয়োগ করতে করতেই তারা শিখবে, শিখতেই থাকবে, ছাত্রজীব’নে যেমন, পেশাজীবনেও এর ব্য’তিক্রম হবে না। ভবিষ্যতে মানসিক ভা’রসাম্য র ক্ষা করার ক্ষেত্রেও তরুণ প্রজন্মকে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ ও যোগ্য হতে হবে। আমরা মূলত ১০ বছর বয়স থেকে আমাদের মধ্যে বড় একটা শারী;রিক-মানসি’ক পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টা টের পাই।

এ পরিবর্তনের হারটা ধীরে ধীরে বেড়ে একসময় তা কমতে শুরু করে। ৫০ পেরোলে আমরা মোটামুটি থিতু হই। তারপর ধীরে-সুস্থে পরিবর্তনহীন একটা জীবনযাপন করে একসময় তার ইতি টানি। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেহেতু এরকম থিতু হওয়ার অবকাশ পাবে না, তাদের যেহেতু দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর নিত্যনতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত

রাখতে হবে, অবশ্যম্ভাবীভাবেই তারা অনেক বেশি উচ্চমাত্রার মানসিক চাপে ভুগবে। এর সঙ্গে হরিষে বি”ষাদ হয়ে যুক্ত হতে পারে তাদের ক্রমবর্ধমান আয়ু। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার ফলে দীর্ঘদিন শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকাও হবে তাদের জন্য আরেকটি কঠিন ও প্রলম্বিত যু’দ্ধ। আমাদের সঙ্গে তরুণ

প্রজন্মের আরেকটা বড় পার্থক্য হবে তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে। আমাদের ছোটবেলায় তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ছিল। আমরা স্কুল-কলেজ থেকে সেসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আমাদের চারপাশের জীবন ও জগৎকে বোঝার চেষ্টা করতাম। আর আগামী দিনে হবে উ’লটো। শিক্ষার্থীরা এত বেশি এবং এত আসল-ন’কল তথ্য-উপাত্ত পাবে যে সেগুলোর কারণেই তাদের পক্ষে চারপাশের

বাস্তবতাকে বোঝা কঠিন হয়ে পড়বে। এখনো সত্য খুঁজে বের করতে হলে সেই তথ্য-উপাত্তই লাগবে, তবে একই সঙ্গে তার প্রবল স্রোতে আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন ডুবে বা হারিয়ে না যায়,

সেটা খেয়াল রাখাটাও খুব জরু রি। আগে তথ্য-উপাত্তের অভা’বে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের কাছে সত্য উন্মোচিত হতো না, আর এখন তথ্য-উপাত্তের প্রতাপে সত্য ঢাকা পড়ে যায়। আগে শিক্ষা ছিল ইটে গাঁথা বাড়ির মতো। সেটাকে আমরা একটা স্থায়ী বিষয় বলে ধরে নিতাম। সত্যি কথা বলতে কী, এখনো আমরা তাই মনে করি। এ কারণেই আমরা অনেকে দীর্ঘ ১০ বছরের ব্য

বধানে তৈরি হওয়া পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমকে মেনে নিতে পারছি না।

কিন্তু স্থির কোনো শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে তো আর দ্রুত ধাবমান পৃথিবীতে টিকে থাকা যাবে না। বর্তমানকালের শিক্ষাকে দালান নয়, হতে হবে তাঁবুর মতো, যাতে প্রয়োজনে জায়গা বদল করতে কোনো অসু’বিধা না হয়। এখনকার শিক্ষার একটা বড় অংশজুড়ে থাকবে সহযোগিতা বা সহমর্মিতার মতো তরল দক্ষতা বা সফট স্কিল যা বিভিন্ন পাত্রে বিভিন্ন আকার নিয়ে বিভিন্ন জানা-অজানা

পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সহজ হয়। ওপরের কয়টি দিক বিবেচনায় নিলে আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন সারা জীবন শিখতে পারে, তাদের ভেতর সেই ক্ষমতা ও মানসিকতা তৈরি করে দিতে হবে।

আগে আমরা বলতাম, লেখাপড়া শেষ করে আমরা একদিন জীবনে ‘সেটল’ হব, সেরকম অমূলক আশা তারা যেন না করে, সেটাও তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। অন্যদিকে, এ ধরনের অনিশ্চয়তা যে উচ্চ মানসিক চাপ তৈরি করবে, এর জন্য তাদের প্রস্তুত করতে হবে।

এসব করার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে নিরন্তর ধেয়ে আসা আসল-নকল তথ্য-উপাত্তের প্রবল স্রোত থেকে খাঁটি তথ্য ছেঁকে নিতে তাদের সূক্ষ্মচিন্তন

দক্ষতার মতো সফট স্কিল শেখাতে হবে। শুধু তাই নয়, এরকম আরও যত সফট স্কিল আছে, তা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন চরিত্রের দিক থেকে সেটা বিল্ডিং না হয়ে কোনো তাঁবুর মতো হয়, যা যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে, যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়।

জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কতটা শিখতে হবে, তা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। তবে যেটুকু স্পষ্ট হয়েছে, শোনা যাচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রমে এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন সরকার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে তা বাস্তবায়ন করতে পারলেই হয়। সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

মা’উশি ও নায়েমের সাবেক ম’হাপরিচালক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *