বিশ্ববাজারে’তেলের দরপতন, কমবে দেশেও”

 বিশ্ববাজারে’তেলের দরপতন, কমবে দেশেও” ‘রপ্তানিকারক দেশগুলোতে মজুত বেড়ে যাওয়া ও ভোক্তা দেশগুলোর চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বিশ্ববাজারে দরপতন হয়েছে রান্নার সয়াবিন ও পাম তেলের।
এতে করে দেড় থেকে দুই মাসের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম কমেছে ৩২ শতাংশ আর পাম তেলের দাম কমেছে ৪৮ শতাংশ।”
এর প্রভাবে পাইকারি বাজারে খোলা ভোজ্যতেলের দাম ও খুচরা পর্যায়ে খোলা তেলের দাম কমলেও বোতলজাত তেলের দাম এখনো সেভাবে কমেনি।
তবে, আন্তর্জাতিক বাজারদর নিম্নমুখী দেখা গেলেও বাংলাদেশে এর কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। এমনকি সরকার যে পদ্ধতিতে দাম নিয়ন্ত্রণ করে তাতে দেশের বাজারে বিশ্ববাজারের প্রভাব পড়তে আরও অপেক্ষা করতে হবে। দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের পরিস্থিতিকেও ছাড়িয়ে গেছে এবারের ধস। একারণে একদিকে ভোক্তাদেরকে বেশি দামে তেল কিনতে হবে না।
অপরদিকে দাম পরতির কারণে আমদানিকারক থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিপুল লোকসানের মুখে পড়েছেন। দর পতনের চিত্র গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দর উঠেছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৯৫০ ডলার। সে সময় প্রতি ডলার ৮৬ টাকা হিসাবে লিটারপ্রতি দর দাঁড়ায় ১৫৩ টাকা।
তবে গত গত বৃহস্পতিবার এই দর নেমে আসে টনপ্রতি ১ হাজার ৩১৮ ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ডলারের দরে (৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা) লিটারপ্রতি দর দাঁড়ায় ১১৩ টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের এই চিত্রেই উঠে এসেছে বাজারের চিত্র।
এই হিসাবমতে দুই মাসে দরপতন হয়েছে ৬৩২ ডলার বা ৩২ শতাংশ। এ তো গেল সয়াবিনের অবস্থা। এর চেয়েও বেশি দরপতন হয়েছে পাম তেলের।
মালয়েশিয়ার কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বুশরা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভসে গত ৫ মে অপরিশোধিত পাম তেল বেচাকেনা হয় ৭ হাজার ৩৮২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা লিটারপ্রতি প্রায় ১৩৯ টাকায়।
বুধবার এ দর নেমে আসে ৩ হাজার ৮৫০ রিঙ্গিত বা লিটারপ্রতি ৭১ টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসে পাম তেলের দর কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশের সয়াবিন তেলের মূল বাজার ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। এই দুই দেশ থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করে ঢাকা।
এছাড়া ইন্দোনেশিয়া থেকে হালকা পরিশোধিত আকারে আরবিডি পাম তেল আমদানি করা হয়। ফলে দুই দেশে পড়া প্রভাবের ধাক্কা লাগবে বাংলাদেশের বাজারেও। এ কারণে দ্রুতই দাম কমে আসবে। পণ্যবাজার বিশ্লেষক আসির হক প্রথম আলোকে বলেন, ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বাজার পড়তির দিকে ছিল।
উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানিকারক দেশগুলোতে মজুত বেড়ে যাওয়া এবং ভোক্তা দেশগুলোর চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বাজারে এমন দরপতন হচ্ছে। দেশের পাইকারি বাজারে বিশ্ববাজারের প্রভাব দেশের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ। যেখানে বিশ্ববাজারের সাথে মিলিয়ে প্রতি ঘণ্টায় দর ওঠানামা করে।
বৃহস্পতিবার পাইকারি বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকায়। দুই মাসের ব্যবধানে লিটারপ্রতি দাম কমেছে ২০ থেকে ২২ টাকা। পাম তেল লিটারপ্রতি ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে ১১২ টাকা ও ১২৫ টাকায়। খাতুনগঞ্জের আরএম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার সাহেদ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পাইকারি বাজার কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মতো দর ওঠানামা করে।
বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার সময় যেমন এখানে প্রভাব পড়েছে, তেমনি বিশ্ববাজারে দরপতনে এখানে দামে ধস নেমেছে। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা বেচাকেনায় বড় লোকসানের মুখে পড়েছেন। দাম কমবে বোতলজাত তেলের পাইকারি বাজারে খোলা তেলের দাম কমে আসায় প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।
বৃহস্পতিবার টিসিবির হিসাবে ঢাকার বাজারে খোলা সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। পাম তেল বেচাকেনা হয়েছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। এক মাসের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের দাম ৬ শতাংশ এবং পাম তেলের দাম ১২ শতাংশ কমেছে।
পাম তেলের বড় অংশই খোলা বেচাকেনা হয়। অপরদিকে সয়াবিন তেলের বড় অংশ বেচাকেনা হয় বোতলজাত হিসেবে। বোতলজাত তেলের দাম গত ২৬ জুন এক দফায় লিটারপ্রতি ৬ টাকা কমানো হয়েছে। দাম কমানোর পর বিশ্ববাজারে আরও পতন হয়েছে। তবে এখনো কমানো হয়নি।
বোতলজাত তেলের দাম সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। সে ক্ষেত্রে তিন ধরনের দর পর্যালোচনা করে   সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই তিনটি হলো এক মাসে গড়ে কত দরে ঋণপত্র খোলা হয়েছে, এক সপ্তাহে কত দরে বন্দর দিয়ে তেল আমদানি হয়েছে এবং এক সপ্তাহে কত দরে ট্যাংক টার্মিনাল থেকে তেল বাজারজাতের জন্য খালাস হয়েছে।
বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমলেও এখনো এ তিন ধরনের দর খুব একটা কমেনি। যেমন বিশ্ববাজারে এখন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দর চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত টনপ্রতি ১ হাজার ৩৯০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ ডলার। এবার দেখা যাক দেশে কোন দরে ঋণপত্র খোলা ও আমদানি হয়েছে।
জুনের শেষ সপ্তাহে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিনের ঋণপত্র খোলা হয়েছে গড়ে ১ হাজার ৮১৭ ডলারে। বন্দর দিয়ে সর্বশেষ আমদানি হওয়া সয়াবিন তেলের টনপ্রতি মূল্য ১ হাজার ৮৫১ ডলার। জুলাই মাসে ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাস হওয়া সয়াবিনের টনপ্রতি গড় মূল্য ছিল ১ হাজার ৭৯১ ডলার।
অর্থাৎ দাম কমলেও এখনো দেশে সেই তেল পৌঁছায়নি। তবে ধীরে ধীরে এক থেকে দুই মাসের মধ্যে হ্রাসকৃত মূল্যের তেল দেশে পৌঁছাবে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। বিশ্ববাজারে তেলের দামে ধস ২০০৮ সালের এপ্রিলে বৈশ্বিক মন্দা শুরুর আগে বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
কিন্তু মন্দা শুরুর পর দরপতন শুরু হয়। এর প্রভাবে এক মাসেই লিটারে দাম কমে প্রায় ১৬ টাকা, আর চার মাসের ব্যবধানে দাম কমে ৫০ শতাংশ। এরপর বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দামে আরেক দফা উত্থান ঘটে। তবে ২০১২ সালের শেষে আবারও দরপতন শুরু হলে ব্যবসায়ীরা ধাক্কা খান। পরপর দুই ধাক্কার কারণে এই ব্যবসা থেকে সরে যায় বড় কয়েকটি গ্রুপ।
২০০৮ ও ২০১২ সালের চেয়ে এবারের পতনের হার বেশি। এবার এক মাসেই পাম তেলের দাম কমেছে ৩৭ শতাংশ, যেটি আগে কখনো হয়নি। বড় লোকসানের মুখে ব্যবসায়ীরা দেশের সয়াবিন তেলের বাজারের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ টি কে গ্রুপ। চলতি সপ্তাহে তারা অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করেছে টনপ্রতি ১ হাজার ৮৫১ ডলারে।
অথচ বিশ্ববাজারে এখন একই তেল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলে দর পড়বে ১ হাজার ৪৫০ ডলার। অর্থাৎ ঋণপত্র খুলে দেশে আনতেই বিশ্ববাজারে প্রতি টনের দর পড়ে গেছে ৪০০ ডলার। টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আথহার প্রথম আলোকে বলেন, বন্দর দিয়ে এখন যেসব তেল আমদানি হচ্ছে, তার ঋণপত্র বিশ্ববাজারে চড়া দাম থাকার সময় খোলা হয়েছে। হঠাৎ দরপতনের কারণে এখন বড় লোকসানের মুখে পড়বে সবাই।
সবচেয়ে বেশি লোকসান হচ্ছে আগে বিক্রি করে দেওয়া তেলের আমদানি দায় শোধ করতে গিয়ে। এ সপ্তাহে টি কে গ্রুপ ৯৯ টাকা ৪০ পয়সা দরে ডলার কিনে আমদানি বিল পরিশোধ করেছে, যে ঋণপত্র খোলার সময় ডলারের দর ৮৬ টাকা ছিল। এ ধাক্কা সামলানো কঠিন।
মালয়েশিয়ার ‘দ্য এজ মার্কেট’ অনলাইনের ৭ জুলাইয়ের খবরে বলা হয়, পাম তেলের দাম কমে যাওয়ায় ভারত, পাকিস্তানের আমদানিকারকেরা উচ্চ দামে কেনা চুক্তি পর্যালোচনা করতে চাইছেন।
চুক্তির পর আমদানি না করা চালানের সংখ্যা বাড়ছে। মূলত হঠাৎ দরপতনে বিপুল লোকসান ঠেকাতে আমদানিকারকেরা এ চেষ্টা করছেন বলে খবরে বলা হয়। দেশে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। আর আমদানি করা বীজ মাড়াই করে সয়াবিন উৎপাদন করা হয়।
বছরে ২১ লাখ টন তেল আমদানি হয় আর মাড়াই করে তিন লাখ টন সয়াবিন পাওয়া যায়। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছরে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে ২৮০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। এ ব্যয় ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ৯৬ কোটি ডলার বেশি। বিশ্ববাজারে দরপতনের কারণে তেল আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমবে। ভোক্তারাও সুফল পাবেন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *